
বিদ্যুৎ আধুনিক সভ্যতার অন্যতম চালিকা শক্তি। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের জীবনমানে যে পরিবর্তন লক্ষণীয় তার পেছনে এই শক্তির অবদানই বেশি। বিদ্যুতের অগ্রগতিই হচ্ছে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিমাপক। একটি দেশের কতজন লোক বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে বা পারক্যাপিটা কনজাম্পশনই কত, তার সঠিক চিত্র প্রতীয়মান হয় সে দেশ কতটা উন্নত। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, তা মূল্যায়ন করার প্রয়োজন মানবউন্নয়নের সূচক বিবেচনার জন্য। সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমানে প্রায় ৪৩ ভাগ লোক বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। তবে এ পরিসংখ্যানকে যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে জনবহুল পল্লীবাসীর তুলনায় শহরাঞ্চলের মানুষ বেশি বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। যদিও সময়ের পরিবর্তনে প্রত্যন্ত গ্রামে খুটি পৌঁছেছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য হলেও ঐ লাইনে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হচ্ছে না ২/১ ঘণ্টার বেশি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিল্পায়ন, নগরায়ন, কৃষির আধুনিকায়নের যে ক্রমোগতি পরিলক্ষিত সেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার অধিকমাত্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জনসংখ্যার অনুপাতে কৃষি জমির পরিমাণ কম হওয়ায় বিদ্যমান স্বল্প জমিতে হাইব্রিড শস্য উৎপাদন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর জন্য বিদ্যুৎ নির্ভর সেচ অপরিহার্য হয়ে পড়ে পল্লীঅঞ্চলে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে রাতারাতি বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্যকর ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। বিদেশীদের পরামর্শে খন্ডিত চেতনায় সময়ে সময়ে গৃহীত উদ্যোগ আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে লাগসই করতে পারেনি। দেশীয় চেতনার পরিবর্তে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা যেমন লাগসই হয়নি, তেমনি প্রবল ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ায় চুরির নামে সিস্টেম লস, অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়ন, বিকল্প জ্বালানি উৎসের ব্যবহারে সঠিক সিদ্ধান্তহীনতা, কনসালট্যান্সির নামে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দান, এ খাতে যথেষ্ট দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণে ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিকল্পনায় অযাচিত পরিবর্তন, বিদ্যুৎ সেক্টরে কর্মরত প্রকৌশলীদের চরম অর্থলিপ্সা ইত্যাদি কারণে বাড়তি চাহিদার প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বিদ্যুৎ চাহিদার সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তফাৎটা বেড়ে যায়। সিস্টেমে চেপে বসে বিদ্যুৎ ঘাটতি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যায় ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে তা লাগাতার অনুসৃত হয় এবং এক সময়ে গাণিতক হারে বৃদ্ধি পায় এবং ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ ঘাটতি এসে দাঁড়ায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ চাহিদা আর উৎপাদনের মধ্যে তফাৎটা বেশ ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়। নানান কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমশই কমেছে। কখনও জ্বালানির অভাব, কখনওবা নিয়ম মাফিক সংস্করণ ও সংরক্ষণ না করায় মেশিন ডিরেটেড হওয়ায় অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ঘাটতি বাড়তে থাকে। তাছাড়া লোডগ্রোথ অনুযায়ী প্রতি বছর ১০% হারে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা না করার কারণেও বিদ্যুতের এ দুর্দশা। এছাড়া বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মাত্রারিক্ত লুটপাট এবং তাদের সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়ন, প্রকৌশলীদের আত্মঘাতি কার্যক্রম এ খাতে চরম বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল মর্মে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা গেছে বিদ্যুতের খুটি বাণিজ্য যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, সে অনুপাতে বিদ্যুৎ খাত সংস্কার ও উৎপাদনে ততটা মনোনিবেশ করা হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ নির্ভর সেচ মৌসুম এবং মাত্রারিক্ত গরমে আবাসিক বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি ও শিল্পে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশবাসী চরম লোডশেডিং এর যাঁতাকলে পড়ে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে বর্তমান মহাজোট সরকার জোড়াতালির মাধ্যমে এ চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ স্বল্পমেয়াদি কোন বিষয় নয়। এর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যাপক সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনগণ সেটি দেখতে চায় না। তারা চায় চাহিদা মাফিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। তা সত্বেও বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৯, ২০১৫ এবং ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০৬৬ মেগাওয়াট, ৯৭৮৬ মেগাওয়াট ও ১৩৯৯৩ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত আরইবির অধীনে উলাপাড়া ১১ মেগাওয়াট, হবিগঞ্জ ১১ মেগাওয়াট, মাওনা ৩৩ মেগাওয়াট ও রূপগঞ্জ ৩৩ মেগাওয়াট ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বিউবোর অধীনে ফেনী গ্রিড সাবস্টেশন ২২ মেগাওয়াট, মহীপাল ১১ মেগাওয়াট, বাড়বকুণ্ড ২২ মেগাওয়াট, জাঙ্গালিয়া ৩৩ মেগাওয়াট ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ১৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জুনের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উলাপাড়া ১১ মেগাওয়াট ও হবিগঞ্জ ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু'টি টেস্ট রানে আছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বিবরণী থেকে জানা যায়। এছাড়া বেসরকারিভাবে ৩ বছরমেয়াদি ভাড়ায় কেনা বিদ্যুৎ ভোলা ৩৪ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, বগুড়া ২০ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট, শিকলবাহার ৫০ মেগাওয়াটের ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ২০৯ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৫ বছর মেয়াদি শাহাজিবাজার ৮০ মেগাওয়াট, কুমারগাঁও ১০ মেগাওয়াট ও ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াটের ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সরকারিভাবে সিদ্ধিরগঞ্জে ১০৫ মেগাওয়াট করে দুইটি ইউনিট থেকে পাওয়া যাবে আরো ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সবমিলিয়ে মোট ৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এর মধ্যে ১৫ বছর মেয়াদী শাহাজিবাজার ৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি টেস্ট রানে আছে বলে জানা যায়। তথ্য মতে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট, সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট, খুলনা ২১০ মেগাওয়াট, ভোলা ১৫০ মেগাওয়াট এবং চাদপুর ১৫০ মেগাওয়াটের মোট ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৯৬০ মেগাওয়াট। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট, সিদ্ধিরগঞ্জে ১৫০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিট, বড়পুকুরিয়ায় ১২৫ মেগাওয়াটের ৩য় ইউনিট, ভেড়ামারা ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ১২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। বেসরকারিভাবে বিবিয়ানা ও সিরাজগঞ্জ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট করে ২টি কেন্দ্র থেকে ৯শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ২১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্বাসন করে আরো ১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এর মধ্যে কর্ণফূলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫০ মেগাওয়াটের ৩য় ইউনিট, খুলনা ৬০ মেগাওয়াট ও ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫৫ মেগাওয়াটের ১ম ইউনিটের সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে সরকারি হিসেবে বিদ্যুতের সিস্টেম লস ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোর জন্যও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে সংস্থাভিত্তিক বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তদারকিকরণ, বিদ্যুৎ ক্রয় ও বিক্রয়ের হিসাবের স্বচ্ছতা আনয়ন, প্রি-পেইড মিটারসহ আধুনিকমানের ডিজিটাল মিটার স্থাপন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ উল্লেখযোগ্য। তবে এসব উদ্যোগ যেন অন্যান্য আইনের ন্যায় কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ না থাকে সে দিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
দেশবাসীকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখিত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে পরিকল্পনা মাফিক বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পূর্বে অবশ্যই চাহিদার সাথে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে। চাহিদা এবং যোগানের দিক বিবেচনায় সরকার ১৬ জুন থেকে ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে এক ঘণ্টা ঘড়ির কাটা এগিয়ে আনার প্রেক্ষিতে প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের যে জাতীয় মানসিকতা তাতে করে সরকারের এ পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য চরম দিনের আলোতে সরকারি অফিস আদালত এবং ধনীপাড়ায় বিদ্যুতিক লাইট অপ্রয়োজনীয়ভাবে জ্বলতে দেখা যায়। কারণ আমাদের মাঝে জাতীয় চেতনা বোধের চরম ঘাটতি রয়েছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে চরম দারিদ্র্য সেটি বলা যাবে না, তবে মানসিকভাবে যে চরম দরিদ্র সেটি জোর দিয়ে বলা যায়। গরীব দেশে আমরা বসবাস করলেও বড়লোকী মনোভাব আমাদের সার্বক্ষণিক তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই ন্যূনতম বিদ্যুতের চাহিদার যোগান যেখানে সরকার দিতে পারছে না, সেখানে স্বয়ং বিদ্যুৎ অফিসের হোমরা চোমরা কর্মকর্তাদের রুমে বিনা প্রয়োজনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। অনুরূপভাবে সরকারি অন্যান্য অফিস আদালতসহ ধনীপাড়ায় যেভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বিল্পব ঘটেছে এবং ঐ সব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের যোগানের জন্য সব দিক থেকে বঞ্চিত পল্লীবাসীর বিদ্যুৎ ঢাকাসহ বড় বড় নগরীতে নিয়ে আসা হচ্ছে-এটি জাতির সাথে এক ধরনের প্রতারণার শামিল। নয় কি মানসিক হীনমন্যতা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে সরকারি অন্যান্য দপ্তরের পাশাপাশি ধনীপাড়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার সংকুচিত করা গেলে ঘড়ির কাটা একঘণ্টা এগিয়ে আনার চেয়ে অনেক গুণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো। রাষ্ট্র পরিচালনার কর্ণধারে যারা নিয়োজিত তারা যেভাবে নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে জাতিকে আইনের শাসনের পথ দেখায় তাতে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন হবার সম্ভাবনা থাকে না। বরং আইন অমান্য করার প্রতি বঞ্চিত মানুষদের একধরনের উৎসাহ যোগায়। সার্বিকভাবে যদি বিদ্যুৎ ঘাটতিকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি এবং আমাদের জীবনমানে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে কর্ম বন্ধ নয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে এ সমস্যা আমরা সহজে মোকাবেলা করতে পারবো। নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পূর্বে উৎপাদন সচল রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে প্রত্যেককে বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছতা সাধনের দৃষ্টান্ত দেখা হবে। এ লক্ষ্যে চলতি আপতকালিন সময়ের জন্য ফ্ল্যাট-ঘরবাড়ী, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালতে এবং অন্যান্য নন-এসেনসিয়াল এলাকায় এয়ারকুলার ও হিটার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সান্ধ্য পিক-আওয়ার্সে ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সময়ে ওয়েলডিং মেশিন, গমের কল, পানির পাম্প, বড় বড় মোটর চালিত যন্ত্রপাতি চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে রাত ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চালু রাখার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। একই সাথে সরকারের ঘোষিত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতা বিবেচনায় নতুন বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট কেনার সময় গ্যাস ব্যতীত কয়লা অথবা অন্য কোন জ্বালানি বা ডুয়েল ফুয়েল ব্যবহারের ব্যবস্থা রেখে প্লান্ট ক্রয় করতে হবে। গ্যাস ঘাটতি ও কয়লা উত্তোলন সমস্যা বিবেচনায় রেখে এখন থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়াম ছাড়াও অন্যান্য উপযুক্ত জ্বালানির খোঁজ করতে হবে। কয়লা উত্তোলনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং এর ব্যবহার অগ্রায়িত করতে হবে। কেননা কয়লা দিয়ে দেশের আগামী ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কেননা আমেরিকায়ও ৪৯% বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কয়লা দিয়ে। এছাড়া জ্বালানি সমস্যা উত্তরণে অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হবে। যেমন সৌর, প্লাস্টিক সোলার পাওয়ার সেল, বায়ু, হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা/বর্জ্য-আবর্জন, সমুদ্রের ঢেউ, জিও থার্মাল এনার্জি, হাইড্রোজেন শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ মেগাওয়াট সোলার ফটোভোল্টিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। জাপান ২০১০ সালের মধ্যে এই ব্যবস্থায় ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদেরকেও এ বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে এবং এখন থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বপরি জাতীয় যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের জীবনযাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে সর্বত্রে থেকে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যায় ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে তা লাগাতার অনুসৃত হয় এবং এক সময়ে গাণিতক হারে বৃদ্ধি পায় এবং ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ ঘাটতি এসে দাঁড়ায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ চাহিদা আর উৎপাদনের মধ্যে তফাৎটা বেশ ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়। নানান কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমশই কমেছে। কখনও জ্বালানির অভাব, কখনওবা নিয়ম মাফিক সংস্করণ ও সংরক্ষণ না করায় মেশিন ডিরেটেড হওয়ায় অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ঘাটতি বাড়তে থাকে। তাছাড়া লোডগ্রোথ অনুযায়ী প্রতি বছর ১০% হারে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা না করার কারণেও বিদ্যুতের এ দুর্দশা। এছাড়া বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মাত্রারিক্ত লুটপাট এবং তাদের সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়ন, প্রকৌশলীদের আত্মঘাতি কার্যক্রম এ খাতে চরম বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল মর্মে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা গেছে বিদ্যুতের খুটি বাণিজ্য যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, সে অনুপাতে বিদ্যুৎ খাত সংস্কার ও উৎপাদনে ততটা মনোনিবেশ করা হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ নির্ভর সেচ মৌসুম এবং মাত্রারিক্ত গরমে আবাসিক বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি ও শিল্পে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশবাসী চরম লোডশেডিং এর যাঁতাকলে পড়ে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে বর্তমান মহাজোট সরকার জোড়াতালির মাধ্যমে এ চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ স্বল্পমেয়াদি কোন বিষয় নয়। এর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যাপক সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনগণ সেটি দেখতে চায় না। তারা চায় চাহিদা মাফিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। তা সত্বেও বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৯, ২০১৫ এবং ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০৬৬ মেগাওয়াট, ৯৭৮৬ মেগাওয়াট ও ১৩৯৯৩ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত আরইবির অধীনে উলাপাড়া ১১ মেগাওয়াট, হবিগঞ্জ ১১ মেগাওয়াট, মাওনা ৩৩ মেগাওয়াট ও রূপগঞ্জ ৩৩ মেগাওয়াট ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বিউবোর অধীনে ফেনী গ্রিড সাবস্টেশন ২২ মেগাওয়াট, মহীপাল ১১ মেগাওয়াট, বাড়বকুণ্ড ২২ মেগাওয়াট, জাঙ্গালিয়া ৩৩ মেগাওয়াট ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ১৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জুনের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উলাপাড়া ১১ মেগাওয়াট ও হবিগঞ্জ ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু'টি টেস্ট রানে আছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বিবরণী থেকে জানা যায়। এছাড়া বেসরকারিভাবে ৩ বছরমেয়াদি ভাড়ায় কেনা বিদ্যুৎ ভোলা ৩৪ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, বগুড়া ২০ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট, শিকলবাহার ৫০ মেগাওয়াটের ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ২০৯ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৫ বছর মেয়াদি শাহাজিবাজার ৮০ মেগাওয়াট, কুমারগাঁও ১০ মেগাওয়াট ও ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াটের ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সরকারিভাবে সিদ্ধিরগঞ্জে ১০৫ মেগাওয়াট করে দুইটি ইউনিট থেকে পাওয়া যাবে আরো ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সবমিলিয়ে মোট ৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এর মধ্যে ১৫ বছর মেয়াদী শাহাজিবাজার ৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি টেস্ট রানে আছে বলে জানা যায়। তথ্য মতে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট, সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট, খুলনা ২১০ মেগাওয়াট, ভোলা ১৫০ মেগাওয়াট এবং চাদপুর ১৫০ মেগাওয়াটের মোট ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৯৬০ মেগাওয়াট। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট, সিদ্ধিরগঞ্জে ১৫০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিট, বড়পুকুরিয়ায় ১২৫ মেগাওয়াটের ৩য় ইউনিট, ভেড়ামারা ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ১২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। বেসরকারিভাবে বিবিয়ানা ও সিরাজগঞ্জ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট করে ২টি কেন্দ্র থেকে ৯শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ২১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্বাসন করে আরো ১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এর মধ্যে কর্ণফূলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫০ মেগাওয়াটের ৩য় ইউনিট, খুলনা ৬০ মেগাওয়াট ও ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫৫ মেগাওয়াটের ১ম ইউনিটের সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে সরকারি হিসেবে বিদ্যুতের সিস্টেম লস ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোর জন্যও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে সংস্থাভিত্তিক বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তদারকিকরণ, বিদ্যুৎ ক্রয় ও বিক্রয়ের হিসাবের স্বচ্ছতা আনয়ন, প্রি-পেইড মিটারসহ আধুনিকমানের ডিজিটাল মিটার স্থাপন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ উল্লেখযোগ্য। তবে এসব উদ্যোগ যেন অন্যান্য আইনের ন্যায় কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ না থাকে সে দিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
দেশবাসীকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখিত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে পরিকল্পনা মাফিক বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পূর্বে অবশ্যই চাহিদার সাথে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে। চাহিদা এবং যোগানের দিক বিবেচনায় সরকার ১৬ জুন থেকে ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে এক ঘণ্টা ঘড়ির কাটা এগিয়ে আনার প্রেক্ষিতে প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের যে জাতীয় মানসিকতা তাতে করে সরকারের এ পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য চরম দিনের আলোতে সরকারি অফিস আদালত এবং ধনীপাড়ায় বিদ্যুতিক লাইট অপ্রয়োজনীয়ভাবে জ্বলতে দেখা যায়। কারণ আমাদের মাঝে জাতীয় চেতনা বোধের চরম ঘাটতি রয়েছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে চরম দারিদ্র্য সেটি বলা যাবে না, তবে মানসিকভাবে যে চরম দরিদ্র সেটি জোর দিয়ে বলা যায়। গরীব দেশে আমরা বসবাস করলেও বড়লোকী মনোভাব আমাদের সার্বক্ষণিক তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই ন্যূনতম বিদ্যুতের চাহিদার যোগান যেখানে সরকার দিতে পারছে না, সেখানে স্বয়ং বিদ্যুৎ অফিসের হোমরা চোমরা কর্মকর্তাদের রুমে বিনা প্রয়োজনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। অনুরূপভাবে সরকারি অন্যান্য অফিস আদালতসহ ধনীপাড়ায় যেভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বিল্পব ঘটেছে এবং ঐ সব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের যোগানের জন্য সব দিক থেকে বঞ্চিত পল্লীবাসীর বিদ্যুৎ ঢাকাসহ বড় বড় নগরীতে নিয়ে আসা হচ্ছে-এটি জাতির সাথে এক ধরনের প্রতারণার শামিল। নয় কি মানসিক হীনমন্যতা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে সরকারি অন্যান্য দপ্তরের পাশাপাশি ধনীপাড়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার সংকুচিত করা গেলে ঘড়ির কাটা একঘণ্টা এগিয়ে আনার চেয়ে অনেক গুণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো। রাষ্ট্র পরিচালনার কর্ণধারে যারা নিয়োজিত তারা যেভাবে নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে জাতিকে আইনের শাসনের পথ দেখায় তাতে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন হবার সম্ভাবনা থাকে না। বরং আইন অমান্য করার প্রতি বঞ্চিত মানুষদের একধরনের উৎসাহ যোগায়। সার্বিকভাবে যদি বিদ্যুৎ ঘাটতিকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি এবং আমাদের জীবনমানে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে কর্ম বন্ধ নয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে এ সমস্যা আমরা সহজে মোকাবেলা করতে পারবো। নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পূর্বে উৎপাদন সচল রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে প্রত্যেককে বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছতা সাধনের দৃষ্টান্ত দেখা হবে। এ লক্ষ্যে চলতি আপতকালিন সময়ের জন্য ফ্ল্যাট-ঘরবাড়ী, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালতে এবং অন্যান্য নন-এসেনসিয়াল এলাকায় এয়ারকুলার ও হিটার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সান্ধ্য পিক-আওয়ার্সে ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সময়ে ওয়েলডিং মেশিন, গমের কল, পানির পাম্প, বড় বড় মোটর চালিত যন্ত্রপাতি চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে রাত ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চালু রাখার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। একই সাথে সরকারের ঘোষিত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতা বিবেচনায় নতুন বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট কেনার সময় গ্যাস ব্যতীত কয়লা অথবা অন্য কোন জ্বালানি বা ডুয়েল ফুয়েল ব্যবহারের ব্যবস্থা রেখে প্লান্ট ক্রয় করতে হবে। গ্যাস ঘাটতি ও কয়লা উত্তোলন সমস্যা বিবেচনায় রেখে এখন থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়াম ছাড়াও অন্যান্য উপযুক্ত জ্বালানির খোঁজ করতে হবে। কয়লা উত্তোলনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং এর ব্যবহার অগ্রায়িত করতে হবে। কেননা কয়লা দিয়ে দেশের আগামী ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কেননা আমেরিকায়ও ৪৯% বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কয়লা দিয়ে। এছাড়া জ্বালানি সমস্যা উত্তরণে অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হবে। যেমন সৌর, প্লাস্টিক সোলার পাওয়ার সেল, বায়ু, হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা/বর্জ্য-আবর্জন, সমুদ্রের ঢেউ, জিও থার্মাল এনার্জি, হাইড্রোজেন শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ মেগাওয়াট সোলার ফটোভোল্টিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। জাপান ২০১০ সালের মধ্যে এই ব্যবস্থায় ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদেরকেও এ বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে এবং এখন থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বপরি জাতীয় যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের জীবনযাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে সর্বত্রে থেকে।