উন্নয়নশীল সয়াবিনের জেলা লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের নিরব বিল্পব্ : কর্তৃপক্ষের যথাযথ দৃষ্টিতে গড়ে উঠতে পারে বৃহৎ সয়াবিন ভিত্তিক শিল্পকারখানা


দক্ষিণাঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুর নারকেল-সুপারির জন্য প্রসিদ্ধ হলেও গত কয়েক বছরে ঘটে গেছে নীরব সয়াবিন বিপ্লব। লক্ষ্মীপুরে গড়ে উঠতে পারে সয়াবিনভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সয়াবিন থেকে তৈরি হতে পারে তেল, পোলট্রি খাদ্যসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য। সয়াবিনকে ঘিরে লক্ষ্মীপুরে হাতছানি দিচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনার। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সয়াবিন চাষ হয়েছে। দেশের শীর্ষ সয়াবিন উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে ইতোমধ্যে এটি তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৮০ ভাগই উৎপন্ন হয়ে থাকে এ অঞ্চলে। এ বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি সয়াবিন উৎপাদনের আশা করছেন কৃষকরা। জেলা কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চাষ হয়েছে ৩৩ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে রামগতি উপজেলায় চাষ হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর, কমলনগরে ১২ হাজার, রায়পুরে ৪ হাজার ৪১০, রামগঞ্জে ৫০ এবং সদরে ৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর। গত ছয়-সাত বছর ধরে এ জেলায় সয়াবিনের চাষ হলেও এবারই প্রথম সয়াবিন চাষ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত না হানলে এ বছর ৬৬ হাজার টন সয়াবিন উৎপাদনের আশা করছেন কৃষিবিদরা। তবে কৃষকরা সরকারি হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ বেশি উৎপাদনের আশা করছেন। এ দিকে সয়াবিনকে ঘিরে এ অঞ্চলে বিশেষ করে রামগতি ও কমলনগরে এক সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দাদন ব্যবসায়ীরা। বেশির ভাগ কৃষক প্রান্তিক ও বর্গাচাষি হওয়ায় সয়াবিন চাষের মৌসুমে তাদের হাতে নগদ টাকা থাকত না। কৃষকের দরিদ্রতার সুযোগে মহাজনরা নামমাত্র মূল্যে আগাম কিনে নিতেন ক্ষেতের সয়াবিন। এতে করে দাদন শোধ করার পর কৃষকের জন্য কিছুই থাকত না। এমনকি উল্টো কৃষকরা আরো ঋণভারে জর্জরিত থাকতেন। কৃষকদের এ শোষণ বঞ্চনা নিয়ে গত বছর দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলে তা নজরে পড়ে যৌথবাহিনীর। শুরু হয় দাদনবিরোধী অভিযান। এ অভিযান নিষ্পেষিত কৃষকদের জীবনে বয়ে আনে আশীর্বাদ। টাকার অভাবে ক্ষেতের যে সয়াবিন কৃষক নামমাত্র মূল্যে মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন দাদন বিরোধী অভিযানের মুখে মহাজনরা ওই বছর ক্ষেতের সয়াবিন তুলে নেয়ার সাহস করেনি।
উৎপাদিত সয়াবিন কৃষক বাজারমূল্যে বিক্রি করেই ফেরত দেন দাদনের টাকা। এতে প্রতিমণ সয়াবিনে কৃষকের লাভ হয় প্রায় ৭০০-৮০০ টাকা। এ লাভের টাকা জমিয়ে রেখে এবার দাদন ছাড়াই বেশির ভাগ প্রান্তিক ও বর্গাচাষি চাষ করেছেন সয়াবিন। মহাজনের মুখাপেক্ষী না হয়ে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এ ছাড়া বর্গাচাষিরা নিজস্ব জমিজমা না থাকায় এত দিন ব্যাংক ঋণ না পেলেও গত বছর সরকার বর্গাচাষিদের জামানত ছাড়া সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে নতুন অধ্যাদেশ জারি করে। এতে করে অনেকে এ বছর ব্যাংক ঋণ নিয়ে সয়াবিন চাষের সুযোগ পেয়েছেন। কৃষকরা জানিয়েছেন, গত বছরের দাদনবিরোধী সফল অভিযান, ফসলের সঠিক দাম প্রাপ্তি এবং সরকারি ঋণ সুবিধা পাওয়ায় তারা এ বছর ব্যাপকভাবে সয়াবিন চাষ করেছেন। এ ছাড়া এবার সময়মতো সার, কীটনাশকও পেয়েছেন গত বছরের চেয়ে কম দামে। বাম্পার ফলনের আশায় এবার তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। নিবিড় যত্নে পরিচর্যা করে যাচ্ছেন ক্ষেতের ফসল। এ দিকে গত বছর ফসলের সঠিক দাম পাওয়া গেলেও এ বছর তা পাওয়া যায় কি না এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে কৃষকরা এবারো প্রশাসনের প্রতি বাজার তদারকি জোরদার করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া কৃষকরা জানিয়েছেন, দেশের উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ ভাগ এ জেলায় উৎপাদিত হলেও এখানে সয়াবিনভিত্তিক কোনো শিল্পকারখানা গড়ে না উঠায় উৎপাদিত ফসল বাজারজাতকরণে তাদের নানা বিপাকে পড়তে হয়। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে তাদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে। সরকারি উদ্যোগে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল যেভাবে সংগ্রহ করা হয় সেভাবে সয়াবিনও সরকারি উদ্যোগে সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
তারা দাবি জানান, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খুব শিগগিরই সয়াবিনভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলার। এ দিকে কৃষকরা যাতে করে সয়াবিনের যৌক্তিক মূল্য পান এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলাম সরকার। তিনি এ অঞ্চলে সয়াবিনভিত্তিক মিলকারখানা গড়ে তোলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। সম্প্রতি জেলা কৃষি অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক এ টি এম ইউনুস মিয়া জানান, সয়াবিন একটি উৎকৃষ্ট আমিষ ও তেলসমৃদ্ধ ফসল। এতে গোশতের চেয়েও বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে। সয়াবিন চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের উন্নত বীজ ও চাষাবাদ এবং বিভিন্ন সয়াখাদ্য তৈরির পদ্ধতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা জানান তিনি। এ ছাড়া এখানে একটি করে সয়া গোশত ও সয়া দুধ ফ্যাক্টরি স্থাপনের প্রস্তাব জেলা কৃষি অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
 

Copyright © 2009 by Your News, Your Site and Mirror Of Lakshmipur,