
আজ থেকে ৮শ' বছর আগে বর্তমান নোয়াখালী জেলার অধিকাংশ স্থান জুড়ে ছিল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা। রামগঞ্জের লামচর, হাসন্দি, কামরদি, নোয়াখালীর যোগদিয়া, ভুলুয়ার চিাদি, লক্ষ্মীপুরের আকুরদিয়া, চরপাতা, বড়াদিয়া, হামছাদি, কল্যানদি, ফেনীর শরিশাদি প্রভৃতি ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পরবর্তী ভাঙ্গাগড়ার বিস্তৃত কাল ইতিহাসের রহস্যময় অধ্যায়।
নোয়াখালীর আসল নাম 'নওয়াখালী'। একশ বছর আগে সোনাপুরের পূর্বদিকে চৌমুহনী হয়ে উত্তরমূখী হয়ে নয়াখাল খনন করা হয় বলে এর নাম নোয়াখালী। কিন্তু এরও ২শ' বছর আগে সম্ভবত নবাব ইসলাম খাঁর হাতে রাজা অনন্ত মাণিক্যের পতনের (১৬১১) সময়কার 'ভোগলিক কবিতা' নামক পুস্তকের বর্ননায় ছিল-'' নোয়াখালী নামে খাল আছে এ জেলায়, এ জন্য জেলার নাম হইয়াছে তায়।
ঝড়, জলোচ্ছাস, নদী ভাঙ্গন, খরা, ফসলহানি, দুর্ভি, রোগ-শোক বহিরাগত আক্রমন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ও সংকটের মধ্য দিয়ে নোয়াখালীর মানুষগুলো আবহমান কাল ধরে জীবন সংগ্রামে টিকে আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের আগমন, বসতিস্থাপন, ও সংমিশ্রনের ফলে তাই এখানে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাও অব্যঅহত ছিল। এরা পরস্পরে আন্তরিক, সহানুভূতিশীল ও অতিথি পরায়ন। যেমন ১৮ শতকে রামগতির নতুন চরে বসতি গড়ে শাহবাজপুর ,ভুলুয়া, সন্দীপ, হাতিয়ার, মেঘনার ভাঙ্গনে সর্বহারা জনগোষ্ঠী এখানে শাহবাজপুরিয়া, ভূলুয়াওয়ালা হাতিয়াওয়ালা (আইচ্ছাওয়ালা), কুইচ্ছাওয়ালা,কাঁকড়াচইরা, বোয়ালপুইয়া. লামচইরা ইত্যাদি আঞ্চলিকতা ভেদে চালচলন, কথাবার্তা, খাওয়া দাওয়া এবং সামাজিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার পার্থক্য পরিলতি হয়। ভূ-সম্পত্তি নিয়ে রক্তয়ী দাঙ্গা হাঙ্গামাই এদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। কার\"শিল্প নোয়াখালী জেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক উপাদান। নান্দনিকতার রুচিশীল ও আভিজাত্যের ছোঁয়া মিলে এ জনপদের পল্লী বধুদের ফুল তোলা, পাটি তৈরি, পাখা, জায়নামাজ, পিঠা-পুলি তৈরির বিশেষ অভিজ্ঞতা ও পারদর্শীতায়। বাশেঁর পাত্র হিসেবে লাই ওড়া লাঙ্গল-জোয়ালে এবং হোগলা পাতার দাড়ি (বিছানা), মাদুর-চাটাই তৈরিতে এখানাকার কারুকার শ্রমিকদের মেধা ও সৃজনশীলতা প্রশংসনীয়। দেশে-বিদেশে এসবের আধুনিক উন্নত বাণিজ্যিক উৎপাদন এসবের প্রসার ঘটাতে পারে। তাতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের কুটির শিল্পের শ্রমও সার্থক হবে। পূনরুদ্ধার হবে আমাদের বাঁশ ও বেত শিল্প। জনশ্র\"তিমতে জমিদার রাজা লক্ষ্মী নারায়নের নামে লক্ষ্মীপুর জেলার নাম করণ হলেও সুপারী, নারিকেল, পান-ধান-মরিচের এদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। লক্ষ্মীপুরের প্রাচীন কীর্তি ও ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলোর মধ্যে ভূলুয়ার রাজবাড়ি, শহর কসবা সমুদ্র বন্দর, ভূলুয়া দিঘী, ভূলুয়া দুর্গ, দালাল বাজার জমিদার বাড়ী ও খোয়া সাগরের দিঘী, সাহাপুরের ইংরেজ কুঠি বাড়ী (সাহেব বাড়ী), রায়পুরের জ্বীনের মসজিদ, রায়পুর বড় মসজিদ, লক্ষ্মীপুর শহরের হিন্দু জিউড় আখড়া, রামগতির বুড়া কর্তার আশ্রম, তিতাখাঁ জামে মসজিদ, দায়রা বাড়ী মসজিদ, মজুপুর মটকা মসজিদ উল্লেখযোগ্য। শবেবরাত, শবে কদর, ঈদ আনন্দ ছাড়াও মেলাগুলোর মধ্যে রামগঞ্জের শ্যামপুর দায়রা শরীফ ও মেলা, চন্দ্রগঞ্জের দেওয়ান শাহ মেলা, দালাল বাজাার ঝুলন মেলা, রামগতির বুড়া কর্তার মেলা, জন্মাষ্টমী ও বৈশাখী মেলা, দূর্গাপূজা ইত্যাদি বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক মিলন মেলা হিসেবে প্রচলিত ও চিরন্তন ঐতিহ্য।
সোনারগাঁর প্রথম স্বাধীন ফখরুদ্দীন মোবাকর শাহের পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন কেন্দ্র এবং প্রদান নৌঁঘাটি ছিল বঙ্গোপসাগর উপকূলের শস্যভান্ডার খ্যাত লক্ষ্মীপুর। নোয়াখালীর লোকেরা ছিল সমুদ্রচারী। গুপ্ত ও পাল যুগে সমতটে (পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন নাম) প্রধান উপকূলীয় নৌঘাঁটি গুলো ছিল মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়। ভূলুয়ার শহর কসবায় (ভবানীগঞ্জের সনি্নকটে) পরবর্তীতে মোঘলদের প্রদান নৌঘাঁটি ছিল। মোঘল নৌবাহিনীর সেনানায়কদের বেশির ভাগই ছিল লক্ষ্মীপুরবাসী। এজেলার খাঁ বা খা উপাধিধারী সব পরিবারই স্বাধীন বারো ভূইয়া প্রধান ঈসা খাঁর বংশধর। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর কুমিল্লা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে এ অঞ্চলের নাম হয় ভূলুয়অ অর্থাৎ লক্ষ্মীপুর।
নবাব মীর কাসিমের আমলে লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও লবন চাষীদের নেতা নওয়াব আলী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের শোষন ও অত্যাচার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। লক্ষ্মীপুরের বীর নায়ক হাজী আলিমুদ্দিন ১৭৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সেনানী ছিলেন। তার বড় ভাই হাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী ছিলেন বালাকোটের স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈয়দ আহম্মদ বেরলবীর প্রধান সহচর। তাঁদের পৌত্র হাজী আবদুর রশীদ খাঁ ছিলেন নোয়াখালীর প্রধান বাঙালীর লড়াইয়ে অন্যতম নেতা ছিলেন পাতলা খান পাঠান। তার বংশধররা লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী অঞ্চলেই বসবাস করেন। তাছাড়া ১৯ শতকের ফরায়েজী আন্দোলন, মুজাহিদ আন্দোলন, ২০ শতকের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, ১৯২০-২১ এর খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩০ এর বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম, ১৯৪২ সালে বৃটিশ হটাও আন্দোলন প্রভৃতিতে লক্ষ্মীপুরের স্বদেশী নেতা সৈয়দ আহমদ খানের নাম উল্লেখযোগ্য। বঙ্গোপসাগরের কূলে নোয়াখালী ভূ-খন্ড প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে জেগে উছে। খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে এ নতুন ভূখন্ডে প্রথম কৃষিজীবি, ব্যবসায়ী ও শিল্পী শ্রেনীর অনার্য 'কিরাত' নামক জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে। চতুর্থ খ্রীষ্টাব্দে কিরাতদের হটিয়ে আর্যরা এবং তেরশা চৌদ্দশ শতকে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তেরশ শতকে 'ভুলুয়া' নামে নতুন নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন রাঢ় দেশের ক্ষত্রিয় রাজকুমার বিশ্বম্ভর শুর। তখন এ রাজ্যের রাজধানী ছিল শিমুলিয়া। ১৮২১ সালে ব্রিটিশ সরকার সন্দীপ মিরেরশরাই সহ ভুলূয়াকে জেলায় পরিনত করে। ১৮৬৮ সালে এ জেলার নামকরণ হয় নোয়াখালী। ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পূর্নগঠনের আওতায় নোয়াখালী, ফেনী (জুগদিয়অ বন্দর)/ লক্ষ্মীপুর পৃথক তিনটি জেরার অস্তিত্ব লাভ করে। নোয়াখালীর প্রাচীন নাম ভূলূয়া। আর ভূলূয়া ছিল লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দক্ষিন তেওয়ারীগঞ্জ সংলগ্ন একটি প্রাচীনতম গ্রামের নাম। প্রাচীন সমতট অঞ্চলের উপকূলীয় প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত ভূখন্ড ভূলূয়ার অংশ ছিল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী। উনিশ শতকের শেষ দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমান অধিবাসীরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। জৈনপুরের মাওলানা কেরামত আলী এবং তার শিষ্য মাওলানা ইমামুদ্দিন এখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি-নীতি শিক্ষা দেন। তাঁদের তত্বাবধানে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠে। তদুপুরি রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুরে মিরানশাহ (৬৯৫), শ্যামপুরে শাহ জকিম উদ্দিন, লক্ষ্মীপর শহরে আজিম শাহ, রামগতিতে চাঁদশাহ ও রায়পুরের পীর ফজরুল্লাহ প্রমুখ পীর সাহেবরা এখানে ধর্ম প্রচারে অবদান রাখেন। তবে হিন্দু জমিদারদের সাথে ইংরেজদের সুসম্পর্কের সুবাদে ১৮৭২ থেকে ১৯১৫ সালে ভুমি জরিপ কালে প্রভাবশালী হিন্দুরা নিজেদের পছন্দমত বিভিন্ন এলাকার হিন্দু নাম করন করে। হিন্দু ও মুসলিম জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। ১৮৮৭ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপুর ইংলিশ স্কুল নামে। তার আগে রামগঞ্জের করপাড়ায় লামচর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈষ্ণবভক্ত ভূলুয়ার রাজারা সংস্কৃতি ও বৈষ্ণব সাহিত্য চর্চা করতেন। ১৬শ' শতকের রাজা লক্ষণ মানিক্য নিজেই সংস্কৃত ভাষা একাধিক নাটক রচনা করেন। যেমন, বিখ্যাত বিজয়, কূবলয়স্য চরিত্র। ষোড়শ শতাব্দীর ভূলূয়ার কবি শেখ সুলায়মানের 'নসিয়ত নামা, নামক কাব্যে ভূলুয়া রাজ্যের চিত্র এভাবে পাওয়া যায়।
ভূলুয়া শহর জান অতি দিব্য স্থান
সেই সে শহর হয় অতি ভাল জান।
সৈয়দ কাজী আছে যথ মুসলমান
নানা জাতি আছে যথ ব্রাক্ষ্মন সজ্জন।
বহুজাতি আছে লোক না যায় কহন
শেখ সোলেমান তাতে ক্ষুদ্র একজন।
এভাবে প্রাচীন ভূলূয়ায় সংস্কৃত ফরাসী ও বাংলা ভাষার সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার ধারণা পাওয়া যায়। এভাবে প্রাচীন ভূলূয়ায় সংস্কৃত ফরাসী ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার ধারণা পাওয়া যায়।
বৃহত্তর নোয়াখালীর লোক সাহিত্যে গ্রাম বাংলার সাধারণ প্রাত্যাহিত জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। প্রচলিত ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, মন্ত্র, লোকছড়া, লোক কিসসা ও মেয়েলী নোয়াখালীর সংস্কৃতির বৈচিত্রের কাল সাক্ষী।